‘হাতের মুঠোয় ভূমিসেবা’ স্লোগানে ভূমিসেবার সকল ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি অধিকতর ব্যবহার করা হচ্ছে। এটুআইয়ের সহায়তায় ই-মিউটেশন, অনলাইনে আরএস খতিয়ান, মুসলিম আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার ক্যালকুলেটর, মৌজা ম্যাপ অনলাইনে প্রকাশে ভূমি মন্ত্রণালয় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশব্যাপী ই-মিউটেশন উদ্যোগ বাস্তবায়নের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ‘ইউনাইটেড নেশনস পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড-২০২০’ পেয়েছে বাংলাদেশ ভূমি মন্ত্রণালয়।
২০১৯ সালের ১ জুলাই তিন পার্বত্য জেলা ব্যতীত সারা দেশে একযোগে শতভাগ ই-নামজারি বাস্তবায়ন শুরু হয়। বর্তমানে ৪৮৫টি উপজেলা ভূমি-সার্কেল অফিস এবং ৩ হাজার ৬১৭টি ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ই-নামজারি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ম্যানুয়াল আবেদন বন্ধ করায় এখন ই-নামজারির কল্যাণে একবারে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষও ঘরে বসে এই সেবা নিতে পারছেন। দালালদের দৌরাত্ম্য, নি¤œতম স্তরে দুর্নীতি বন্ধ হওয়ায় সেবাপ্রার্থীরা স্বল্প সময়-খরচে হয়রানিমুক্ত সেবা গ্রহণে সক্ষম হচ্ছেন। সরকারি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ভূমি ডাটা ব্যাংকের মাধ্যমে শতভাগ খাস জমি চিহ্নিতকরণ, ছবিসহ খাস জমি, অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি, সায়রাত মহালের শক্তিশালী ডাটাবেজ তৈরি করে জনগণের জন্য তথ্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। ফলে অনলাইন সফটওয়্যার ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে খাসজমি বন্দোবস্ত, জল-বালুমহাল ও হাটবাজার ইজারা দেওয়া যাচ্ছে। দ্রুত সময়ে ভূমি সেবা নিষ্পন্নে ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক দেশজুড়ে ১ হাজার ৬৩৯টি ভূমি অফিস স্থাপনের উদ্যোগ উঁচুমাত্রিকতায় উচ্চকিত।
এছাড়াও ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্পের আওতায় ১৭ ধরনের ভূমিসেবা অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার তথা ই-মিউটেশন, রিভিউ ও আপিল মামলা ব্যবস্থাপনা, অনলাইন ভূমি উন্নয়ন কর, রেন্ট সার্টিফিকেট মামলা ব্যবস্থাপনা, মিউটেটেড খতিয়ান, ডিজিটাল ল্যান্ড রেকর্ড, মৌজা ম্যাপ ডেলিভারি সিস্টেম, মিস মামলা ব্যবস্থাপনা, কৃষি ও অকৃষি খাস জমি ব্যবস্থাপনা, দেওয়ানি মামলা তথ্য ব্যবস্থাপনা, হাটবাজার ব্যবস্থাপনা, জল-বালুমহাল ব্যবস্থাপনা, চা-বাগান ব্যবস্থাপনা, ভিপি সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা, ভূমি অধিগ্রহণ ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ বাজেট ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ‘ল্যান্ড ইনফরমেশ সার্ভিস ফ্রেমওয়ার্ক’ সিস্টেম সফটওয়্যারের মাধ্যমে একই কাঠামোয় আনার প্রচেষ্টা অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিভাত। হাতের মুঠোয় ভূমিসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য নেওয়া হয়েছে যুগান্তকারী প্রকল্প। এ প্রকল্পে স্যাটেলাইট ও ড্রোনের সহায়তায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে নির্ভুলভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করা হয়। এ লক্ষ্যে সারা দেশের ৪৭০টি উপজেলার মৌজা পর্যায়ে জিওডেটিক সার্ভের মাধ্যমে ২ লাখ ৬০ হাজার ৩১০টি জেও-রেফারেন্সিং পয়েন্ট নির্ধারণ এবং ১ লাখ ৩৩ হাজার ১৮৮টি মৌজা ম্যাপের ডাটাবেজ প্রস্তুত করা হচ্ছে। কৃষি জমি সুরক্ষা এবং নিরাপদ আবাসন সুনিশ্চিতে মৌজা ও প্লটভিত্তিক জাতীয় ডিজিটাল ভূমি জোনিং প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমির গুণাগুণ অনুযায়ী ভূমিকে প্লটওয়ারি কৃষি-আবাসন-বাণিজ্যিক-পর্যটন ও শিল্প উন্নয়ন ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে মৌজা ও প্লটভিত্তিক ডিজিটাল ভূমি জোনিং ম্যাপ ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জনে ভূমি মন্ত্রণালয় সফল ও সার্থক।
বিদ্যমান ভূমি অফিসমূহের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দূরীকরণের লক্ষ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের জবাবদিহি আনতে ভূমিসেবা ডিজিটালাইজেশনের কার্যক্রমকে মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর চলমান ডিজিটাইলাজেশন কার্যক্রম ও ভূমি আইন সম্পর্কে পারদর্শী করতে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ভূমি অফিসসমূহে ডিজিটাল ডিভাইস প্রদান করা হয়েছে যাতে সেবা প্রদান দ্রুত ও ত্রুটিমুক্ত হয়।’ ‘বর্তমানে সাধারণ নাগরিকগণ ভূমি অফিসে না এসে নামজারি-আনলাইনে সার্টিফাইড পর্চা-মৌজা ম্যাপের জন্য আবেদন, ঘরে বসেই খতিয়ান বা ম্যাপ পেয়ে যাচ্ছেন এবং খাজনা দিতে পারছেন। যে কোনো ভূমি সেবা সম্পর্কে জানতে বা অভিযোগ জানাতে হটলাইন (১৬১২২) কল করতে পারছেন।
পরিসংখ্যান অনুসারে, ই-নামজারি ব্যবস্থায় বর্তমানে প্রতি মাসে অনলাইনে ২ লক্ষাধিক নামজারি নিষ্পত্তি হচ্ছে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছে প্রায় ৮৪ লাখ নামজারি মামলা। নামজারি সিস্টেম থেকে আনলাইনে আদায়কৃত প্রায় ১৬০ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে। ২০২১ সালে উদ্বোধনের পর থেকে প্রায় ৪ কোটির বেশি হোল্ডিং ডাটা ম্যানুয়াল থেকে ডিজিটালে রূপান্তরিত হয়েছে। নাগরিকদের অনলাইনে দাখিলা প্রদান করা হয়েছে প্রায় ৫৭ লাখের বেশি। অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় হয়েছে ৫১৯ কোটি টাকা। বর্তমানে ৫ কোটি ২১ লাখের অধিক জমির মালিকানা এবং ৭৫ হাজারের বেশি মৌজা ম্যাপ তথ্য অনলাইনে রয়েছে। তিন লাখের মতো খতিয়ান ডাক বিভাগের মাধ্যমে নাগরিকগণ হাতে পেয়েছেন। এ সিস্টেম থেকে প্রায় ১৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা সরকারি রাজস্ব আদায় হয়। প্রতিনিয়ত নামজারি খতিয়ান যুক্ত হচ্ছে এ সিস্টেমে। কলসেন্টার থেকে প্রায় ১০ দশমিক ২০ লাখ কল নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এছাড়াও বিদেশ থেকে নিষ্পত্তিকৃত কলের সংখ্যা প্রায় ৬০০০। প্রায় ১১ হাজার ৪০০ ফলো-আপ কল করা হয়েছে। নাগরিকদের ২০ হাজার ৮০০টি ভূমি সংক্রান্ত আইনি পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে।
বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদদের মতানুসারে, ভারতবর্ষ বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ব্যবস্থার বিষয়টি এখনো সমাজ পরিবর্তনের ধারায় অত্যুজ্জ্বল। ‘গোলাভরা ধান-পুকুর ভরা মাছ-গোয়াল ভরা গরু’ ইত্যাকার প্রসঙ্গগুলো স্বাপ্নিক-বাচনিক কিছু নয়। ব্রিটিশ শাসনকালে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে অত্যন্ত স্বাভাবিক ও সাবলীল ভূমি ব্যবস্থাপনা পরাস্ত হলেও তার প্রভাব কিন্তু এখনো ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পুরনো দিনের জনগণের স্মৃতিতে ভাস্বর। গ্রামীণ জনপদের যৎসামান্য কিছু অঞ্চলে এর প্রচলন বিরাজিত। দেশ বিভাগ-পাকিস্তান-বাংলাদেশে বহুবার জরিপ কার্য চালানোর ফলে ভূমি ব্যবস্থাপনায় জটিলতা শুধু দীর্ঘায়িতই হয়েছে। আধুনিক চিন্তা চেতনায় পরিশুদ্ধ ভূমি মন্ত্রণালয়ের কার্যকলাপ এবারই সর্বাধিক প্রশংসিত। মাঠপর্যায়ে সঠিক বাস্তবায়নে এর ব্যত্যয় ঘটলে দেশবাসী আবারও হতাশার গভীর গহ্বরে নিপতিত হতে পারে।